একে মাস সাইকোজেনিক ইলনেস, মাস সোশিওজেনিক ইলনেস, মাস সাইকোজেনিক ডিসঅর্ডার, এপিডেমিক ইস্টেরিয়া প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়৷ এটা একটা গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়া রোগের লক্ষণ যা কোনো জীবাণু ছাড়াই বিস্তার লাভ করে৷ এর ফলে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত সম্প্রদায়ে আকস্মিকভাবে ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক লক্ষণ যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার ফলে দেখা দেয়। এই বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবে আকস্মিক উত্তেজনা, স্নায়ুতন্ত্রের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটলে দেখা দেয়৷ মানুষ এমন সব অ আচরণ করে বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব। কিন্তু কোন কারণে আকস্মিক উত্তেজনা, স্নায়ুতন্ত্রের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটে তা অজানা৷ তাই সত্যিকারের কারণ অজানা।
অস্বাভাবিক লক্ষণের পাশাপাশি মাস হিস্টেরিয়াতে শারীরিক কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে৷ প্রতিবারই দেখা দেবে এমন নয় ৷ লক্ষণগুলো হলো: মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, কাশি, গলা ব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি৷
যে সব ঘটনা হতে দেখা গেছে-
১. এমন সব লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া, জৈবিকভাবে যার কোনো ভিত্তি নেই।
২. এমন সব লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া যা ক্ষণস্থায়ী ও বিপজ্জনক নয়।
৩. এমন সব লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া যা আকস্মিকভাবে শুরু হয় এবং আকস্মিকভাবে শেষ হয়।
৪. ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত সম্প্রদায়ে (পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব) দেখা দেয়।
৫. অস্বাভাবিক উদ্বেগ দেখা যায়।
৬. লক্ষণগুলো দেখাদেখি, আওয়াজ এবং মুখের কথায় ছড়াতে দেখা যায়৷
৭. লক্ষণের সূত্রপাত গোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রভাবশালীদের মধ্যে হয় অর্থাৎ যাদের কথা গোষ্ঠীর সবাই বিশ্বাস করে, পরে শিশুদের মধ্যে ছড়ায়৷
৮. নারী অংশগ্রহণকারীদের প্রাধান্য থাকে।
৯. অনেকে ভয়ে, নকল করতে যুক্ত হয়৷
১০. সংক্রমণ ছড়াতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করে।
মাস হিস্টেরিয়ার দুটো ধরন আছে।
১. মাস অ্যাংকজাইটি হিস্টেরিয়া:
বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দেয় ৷ দেখাদেখির মাধ্যমে ছড়ায়৷
২. মাস মোটর হিস্টেরিয়া:
যে কোনো বয়সের মানুষে দেখা দেয় ৷ মহামারী দীর্ঘায়িত হতে পারে৷
উদাহরণ
মাস হিস্টেরিয়ার অনেক উদাহরণ আছে
১. ডান্সিং প্লেগ
ইউরোপে বিভিন্ন সময় ডান্সিং প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে ৷ সবচেয়ে পুরোনো রেকর্ডটি সপ্তম শতাব্দীতে ৷ গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ মানুষ নাচতে শুরু করে ৷ নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে ভেঙে পড়ে তারপর শান্ত হয় ৷ জানা যায় অনেকে ভয়ে নাচতে শুরু করে, কেউ কেউ অন্যকে নকল করতে নাচতে শুরু করে ৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে ডান্সিং প্লেগ সবচেয়ে পুরোনো মাস্ট হিস্টেরিয়ার উদাহরণ।
২. মাংকিম্যান রহস্য
২০০১ সালে ভারতের পুরোনো দিল্লিতে মাংকিম্যান বা কালো বাঁদর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ সে সময় ভারতে প্রচুর লোডশেডিং হতো। ২০০১ সালের মাঝামাঝি রাতে লোডশেডিং হলেই মাংকিম্যান আতঙ্ক শুরু হয়ে যেত৷ গরমে মানুষ ছাদের উপর খোলা বাতাসে ঘুমাতে যেত৷ কেউ ছায়া দেখতো, কেউ লাফিয়ে পার হবার আওয়াজ শুনতো, কাউকে আক্রমণ করতো। রাতে বিদ্যুৎ যাওয়া মাত্র পুলিশের কাছে মাংকিম্যান নিয়ে শত শত অভিযোগ যেত৷ পুলিশ পাহারা দিয়ে, ক্যামেরা লাগিয়েও মাংকিম্যানের কুলকিনারা করতে পারেনি। লোকজন রাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তো৷ সে সময় গণমাধ্যমের মাধ্যমে টিভিতে আসতে পারা অনেক বড় বিষয় ছিল৷ তাই সন্দেহের বশে পুলিশ নোটিশ জারি করে যে ভুল খবর দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তারপর থেকেই মাংকিম্যানের অভিযোগ কমে যায়।
পরবর্তী অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে পুরাতন দিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত প্রতিবেশীদের মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়ায়। আতঙ্কে ট্রিগারের কাজ করে ছায়া৷ অনেকে টিভিতে আসার জন্য ভুল খবর দিত। যারা গায়ে দাগ দেখিয়ে বলে যে তারা আক্রমণের শিকার হয়েছে তাদের কেউ কেউ বিখ্যাত হবার জন্য নিজেই নিজের শরীরে দাগ তৈরি করেছে, বাকিদের ইঁদুর-ছুঁচোর আঁচড়ের দাগ৷ মাংকিম্যানকে ভারতের মাস হিস্টেরিয়ার একটা উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভারতের এই রকম আরেকটি ঘটনা হলো 'বেণীকাটা ভূত'। ভারতের উত্তরাখণ্ডের সরকারি স্কুলে মেয়েদের চিৎকার করে কান্নাকাটির করার যে ভিডিও ভাইরাল হয় সেটাও মাস হিস্টেরিয়ার উদাহরণ৷
৩. রাজশাহীতে অজগর আতঙ্ক
২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর এএইচএম কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা থেকে একটা বার্মিজ অজগর বেরিয়ে গিয়ে শহরে আত্মগোপন করে৷ চিড়িয়াখানার আশেপাশে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বসবাসকারীদের মধ্যে নর্দমায় অজগর দেখতে পাওয়ার আতঙ্ক ছড়ায়৷ আমি থাকতাম ৫ নম্বর ওয়ার্ডে৷ সেখানকার এক নর্দমার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। অল্প সময়ে আতঙ্ক কেটে যায়। দুই বছর সাত মাস পর এই এলাকা থেকে বহু দূরে জেলা জজ কোর্টের বিচারকের বাসভবনের পাশের আখখেত খেকে অজগরটা উদ্ধার করা হয়। এখানে ট্রিগার ছিল নর্দমার পানিতে নড়াচড়া ও ছায়া।
এছাড়া ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জের ছাতকে গবাদিপশু ও মানুষখেকো রাক্ষস আতঙ্কও মাস হিস্টেরিয়ার উদাহরণ৷ শেরপুরে বাঘ আতঙ্কের যে সব বিবরণ শুনেছি তাতে সেটাও আমার কাছে মাস হিস্টেরিয়া মনে হচ্ছে৷ গণমাধ্যম মাস হিস্টেরিয়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
0 coment rios: